মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা

মোঃ শাহাবুদ্দীন
সম্পাদক, পোর্টাল বাংলাদেশ ডটকম
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, ভাষা আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক জিএস, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার এবং বিশ্বনন্দিত ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যাপক গোলাম আযম ২৩ অক্টোবর, ২০১৪ ইং তারিখ বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে ইন্তিকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রাত ১১ টা ৫৫ মিনিটে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেন। সন্ধ্যার পর তার অবস্থা আরো অবনতি হয়। পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। রাত ১০ টা ১০ মিনিটে তিনি ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তিনি ৬ ছেলে ও স্ত্রীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
গত ১৫ জুলাই অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায় ঘোষণার পরে ডিফেন্স টীমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ঘোষণা দেন আপিল করার।ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, এ রায় ন্যায়ভ্রষ্ট ও আবেগতাড়িত। আমরা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্থান-পতনের প্রতিটি ঘটনায় এবং এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অধ্যাপক গোলাম আযমের ভূমিকা ইতিহাস হয়ে থাকবে।স্বেচ্ছায় দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন তার মতো ব্যক্তির পক্ষেই দেয়া সম্ভব হয়েছে। তার চিন্তা- চেতনা, সাহসিকতা আর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে। তাঁর অমর কীর্তির জন্য তিঁনি চির অমর হয়ে থাকবেন।
জানাজা:
অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুর খবর শুনে বিশ্বের ৮১টি শহরে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানও গায়েবানা জানাজায় শরীক হন। মুসলিম বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিবিদ আল্লামা ইউসুফ আল কারযাবির ইমামতিতে গায়েবানা জানাজা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
অধ্যাপক গোলাম আযমের জানাজার নামাজ ২৫-১০-২০১৪ ইং তারিখ (শনিবার) বাদ যোহর বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন তার চতুর্থ ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আল-আযমী। জানাজার আগে বিগ্রে: (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আল আজমীর বক্তব্যে কান্নার রোল পড়ে।
অধ্যাপক গোলাম আযমের জানাজায় বায়তুল মোকাররমে জনসমুদ্রের ঢল নামে। জানাজায় লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জানাজার পরিসর বায়তুল মোকাররম মসজিদ ছাড়িয়ে পল্টন মোড় থেকে মতিঝিল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। অনেকে অবস্থান নেন আশপাশের অলিগলিতে। জানাজায় শরিক হতে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে এবং বাইরে সমবেত হয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বেলা ১১টার দিকেই বায়তুল মোকাররম মসজিদ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মুসল্লিদের উপস্থিতি বায়তুল মোকাররমের আশেপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হয়।
দাফন:
লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাবার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম।শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানী ঢাকার মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে বর্ষীয়ান এই ইসলামপন্থী নেতার দাফন সম্পন্ন হয়।
শহীদী মৃত্যু:
পবিত্র হাদীস মতে, যে মুসলমান শুক্রবার দিন মৃত্যুবরণ করেন, তিঁনি জান্নাতি। অধ্যাপক গোলাম আযম বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে ইন্তিকাল করেছেন। ইংরেজী হিসেবে, রাত ১২টার পর দিন শুরু হয়। আর ইসলামী নিয়মে, সূর্যাস্তের পর দিন শুরু হয়। সুতরাং অধ্যাপক গোলাম আযম শুক্রবার দিন মৃত্যুবরণ করেন এবং রাসূল (সাঃ)-এর হাদীস অনুসারে তিঁনি জান্নাতী।
পবিত্র হাদীসে আরো আছে, যে মুসলমান জিহাদের চেতনা লালন করে না, তার মৃত্যু হবে মোনাফেকী মৃত্যু। আর যে মুসলমান জেহাদের চেতনা লালন করেন, তিঁনি জ্বরে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর মৃত্যু হবে শহীদী মৃত্যু। অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৫৪ সাল থেকে ইসলামী আন্দোলন করেছেন এবং সারাজীবন জেহাদী চেতনা লালন করেছেন। সুতরাং তিঁনি শাহাদাতের মর্যাদা পেয়েছেন।
২০১২ সালের ১২ জানুয়ারী গ্রেফতারের কয়েকদিন পূর্বে একজন সাংবাদিক অধ্যাপক গোলাম আযমকে প্রশ্ন করলেন, আপনার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে মামলার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। আপনার মনের অবস্থা কেমন?
গোলাম আযম : জীবনে অনেকবার গ্রেফতার হয়েছি। মুমিন তো মৃত্যুকে ভয় করে না। যদি অন্যায়ভাবে আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়, তাহলে মনে করব শহীদ হওয়ার গৌরব অর্জন করতে যাচ্ছি। ইসলামি আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে আমি শাহাদতের মৃত্যু কামনা করেছি সারা জীবন। সুতরাং ভয় কিসের? আমি প্রস্তুত আছি।
নিম্নে সংক্ষেপে তাঁর জীবনী তুলে ধরা হলো:
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ই নভেম্বর মঙ্গলবার (বাংলা ১৩২৯ সালের ৫ই অগ্রহায়ণ) ঢাকা শহরের লক্ষ্মীবাজারস্থ মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। গোলাম আযমের পিতা মাওলানা গোলাম কবির| তাঁর পিতামহ মাওলানা আব্দুস সোবহান। মাওলানা আব্দুস সোবহান একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেন। তার সম্পর্কে প্রচলিত ছিলো যে, মেঘনার পূর্ব পারে অতবড় আলেম তখন কমই ছিল।প্রপিতামহ শাইখ শাহাবুদ্দিন। শাইখ শাহাবুদ্দিন একজন বড় আলেম এবং বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। তাদের আদি নিবাস ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও গ্রামে। ইউনিয়নের নামও বীরগাঁও।অধ্যাপক গোলাম আযমের পিতা ১৯৪৮ সালে ঢাকা মহানগরীতে রমনা থানার পূর্ব দিকে মগবাজার এলাকায় জমি কেনার পর ঢাকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।অধ্যাপক আযমের পূর্ব পূরুষগণ কমপক্ষে ৭ পুরুষ যাবত ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বীরগাঁওয়ের বাসিন্দা।
মাতুল বংশের দিক থেকে অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী পরিবার শাহ সাহেব পরিবারের সাথে সম্পর্কিত। তার মাতামহ ছিলেন মরহুম শাহ্ সৈয়দ আব্দুল মোনয়েম।
শিক্ষা জীবন:
১৯৩৭ সালে জুনিয়ার মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বেও সাথে উত্তীর্ণ হন। এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় গোলাম আযম ত্রয়োদশ স্থান লাভ করেন। ১৯৪৪ সালে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকেই আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ঢাকা বোর্ডে দশম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের কাজে জড়িয়ে পড়ায় গোলাম আযম পরীক্ষা দিতে পারেননি এবং ১৯৪৯ সালে দাঙ্গাজনিত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি ১৯৫০ সালে এম. এ পরীক্ষা দেন। ঐ বছর কেউ প্রথম বিভাগ পায়নি। চারজন ছাত্র উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগ লাভ করেন এবং অধ্যাপক গোলাম আযম তাদের মধ্যে একজন।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনে:
ছাত্র হিসেবে যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি সাধারণ ছাত্রদের সমস্যা এবং দেশের সমস্যা নিয়েও সচেতন ভূমিকা পালন করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি ছাত্র জীবন থেকেই। স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই আদর্শবান তরুণ শুধুমাত্র পাঠ্য পুস্তকেই মনোনিবেশ না করে সমাজ সচেতন এবং দেশ প্রেমিক একজন কর্মী হিসেবে ছাত্রাবাসে, ক্যাম্পাসে সর্বত্র ছিলেন সদা তৎপর। ঐ সময় মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্ররাই সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সংগ্রামের ময়দানে নেতৃত্ব দিতেন। তাই ফজলুল হক মুসলিম হলের এই কর্মচঞ্চল যুবক ১৯৪৬-৪৭ সেশনে হলের ছাত্র সংসদেও জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ফজলুল হক হল মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী গোলাম আযম সকল প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং রেকর্ড ভোট লাভ করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার ছিল তার প্যানেলের আর সবাই নির্বাচনে পরাজিত হন। ভিপি ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী। যিনি পরবর্তীকালে সি,এস,পি অফিসার হয়েছিলেন।তার যোগ্যতা ও প্রতিভাগুণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন ১৯৪৭-৪৮ সেশনে। ১৯৪৮-৪৯ সালেও তিনি ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন মিঃ অরবিন্দ বোস।
ভাষা আন্দোলনে অবদান :
ভাষা আন্দোলন শুধু আমাদের ইতিহাসেরই এক বিস্ময় নয়, বরং ভাষার জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার ইতিহাস এটাই প্রথম। বিশ্বের আর কোথাও নিজ ভাষা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্য এতবড় ত্যাগ স্বীকারের ঘটনা ঘটেনি। তদানীন্তন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলা ন্যায়সংগতভাবেই রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু অপরিণামদর্শী ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তনের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিলো।
বাংলা ভাষাকে সঠিক মর্যাদা প্রদানের দাবিতে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরের বছরই প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমসহ ইসলামী ভাবধারায় উজ্জীবিত একদল তরুণের প্রচেষ্টায় তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে এক আন্দোলন গড়ে ওঠে। গোড়া থেকেই ভাষা আন্দোলনের স্থপতিদের একজন সহযোদ্ধা হিসেবে গোলাম আযম সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং তৎপর ভূমিকা পালন করেন।
বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারে লিয়াকত আলী খানের সভায় ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে পঠিত স্মারকলিপি সম্পর্কে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রভাষার দাবি সম্বলিত মেমোরেন্ডামের খসড়া তৈরির ভার আমার উপর অর্পিত হয়েছিল। ডাকসুর তৎকালীন জি, এস, গোলাম আযম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে তা পাঠ করেন এবং ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে লিয়াকত আলী খানকে প্রদান করেন।’’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এই স্মারকলিপিতে শুধুমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিই করা হয়নি, বরং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক সমস্যা এবং দাবী এতে প্রতিফলিত হয়।নিঃসন্দেহে এই স্মারকলিপিটি শুধু ভাষা আন্দোলনের প্রথম ঐতিহাসিক দলিল।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে এবং ব্যাপকভাবে জনগণ এ আন্দোলনে শরীক হন, তখন কর্মক্ষেত্র থেকেই অধ্যাপক গোলাম আযম সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি যখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন, তখনও সেখানে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন। একই কারণে তিঁনি ১৯৫৫ সালে পুনরায় গ্রেফতার হন অধ্যাপক গোলাম আযম।
শিক্ষকতা পেশা:
১৯৫০ সালের ৩রা ডিসেম্বর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কর্মজীবনের সূচনা হলো। তিনি ১৯৫০ সালের ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে রংপুর কারমাইকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। নিজ বিভাগের ছাত্ররা ছাড়াও তার লেকচারের সময় অন্যান্য ক্লাসের ছাত্ররা তার ক্লাসে যোগদান করতো।
তাবলীগ জামায়াত:
ছাত্রজীবন শেষে অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৫০ সালেই তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত হন। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি তাবলীগ জামায়াতের রংপুরের আমীর ছিলেন। তাবলীগ জামায়াত-এর কাজ ছিল কেবল ধর্মীয় প্রচার করা।
তমদ্দুন মজলিস:
তিঁনি শুধুমাত্র তাবলীগ জামায়াতের কাজ করেই তৃপ্তি পাননি। সুনির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচী তাবলীগ জামায়াতের ছিল না। তমদ্দুন মজলিসের কার্যক্রমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার সমাধান ছিল। গোলাম আযম ১৯৫২ সালে তমদ্দুন মজলিসের কাজেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি তমদ্দুন মজলিসের রংপুর জেলার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জামায়াতে ইসলামীতে দায়িত্ব পালন:
অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে জামায়াতে ইসলামীতে সহযোগী (মুত্তাফিক) হিসেবে যোগদান করেন।ভাষা আন্দোলনের কারণে তিঁনি ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হয়ে রংপুর কারাগারে যান। সেখানে অবস্থানকালেই জামায়াতের রুকন হন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তিনি রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এর এক বছর পর তাকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এবং রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৬৯-১৯৭১ সেশনে তিনি জামায়াতে ইসলামী পূর্ব-পাকিস্তানের আমীর নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে মজলিসে শূরার কাছে বিশেষ আবেদনের প্রেক্ষিতে আমীরে জামায়াত-এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করেন।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন:
স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জামায়াত সর্বদাই সোচ্চার ছিলো। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম বিরোধী দলীয় আন্দোলনে একজন প্রথম সারির নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। আইয়ূব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে অধ্যাপক গোলাম আযম অংশগ্রহণ করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার:
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা’ উপস্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালে তার পূর্বেকার প্রস্তাব মতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংবিধানে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা’ সংযোজন করেন।
নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়া:
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে। ১৯৯২ সালে বিএনপি তাকে বিদেশী নাগরিক হিসেবে গ্রেফতার করে। এ সময় তিঁনি ১৬ মাস জেলে ছিলেন। সরকার ১৯৯৩ সালের জুন মাসে বিদেশী নাগরিক হিসেবে যে মামলা করে, এতে সরকার হেরে যায়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিঁনি মুক্ত হন। কিন্তু তখনও নাগরিকত্ব পুনর্বহালের মামলা বাকী ছিল। এ ব্যাপারে দুই বিচারক দুই রকম রায় দেন। এরপর তা তৃতীয় বিচারপতির কাছে গেলে তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে রায় দেন। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করে। এক বছর পর ১৯৯৪ সালের ২২ জুন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৫ জন বিচারপতির সমন্বয়ে পুর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর নাগরিকত্ব বহালের আদেশ দেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অর্ডারকে বেআইনী ঘোষণা করেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর তিঁনি নাগরিকত্ব ফিরে পেলেন।
দায়িত্ব পালন:
অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৪৫-১৯৪৬ সালে পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের এ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ১৯৪৬-১৯৪৭ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের জিএস, ১৯৪৭-১৯৪৮ সেশনে পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি, ১৯৫০-১৯৫৫ সালে অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, ১৯৫২-১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, তমদ্দুন মজলিস, রংপুর, ১৯৫১-১৯৫৪ সালে আমীর, তাবলীগ জামায়াত, রংপুর, ১৯৫৭-১৯৫৯ সালে সেক্রেটারি, জামায়াতে ইসলামী, পূর্ব-পাকিস্তান, ১৯৫৮ সালে সভাপতি, সম্পাদনা পরিষদ, দৈনিক ইত্তেহাদ, ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে (পিডিএম) পূর্ব-পাকিস্তান আঞ্চলিক কার্যপরিষদ-এর জেনারেল সেক্রেটারি, ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের আমন্ত্রণে উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব (ড্যাক) -এর কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ, ১৯৬৯-১৯৭১ সালে আমীর, জামায়াতে ইসলামী, পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা’ উপস্থাপন, ১৯৯১-১৯৯৩ সেশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত, ১৯৯৪-১৯৯৭ সেশনে পুনরায় আমীর নির্বাচিত, ১৯৯৮-২০০০ সেশনে পুনরায় জামায়াতের আমীর নির্বাচিত এবং ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে মজলিসে শূরার কাছে বিশেষ আবেদনের প্রেক্ষিতে আমীরে জামায়াত-এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করেন অধ্যাপক গোলাম আযম।
লেখক ও চিন্তাবিদ :
আন্দোলন এবং সাংগঠনিক কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও অধ্যাপক গোলাম আযম লেখা এবং চিন্তার জগতে তাঁর অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৫৮ সালে তিনি দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব নেন। তিনি সম্পাদকীয়সহ বিভিন্ন কলামে নিয়মিত লিখতেন। তাফসীর, নবী জীবন, ইসলাম, সংগঠন, আন্দোলন, রাজনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে এ পর্যন্ত ১০৭ টি বই লিখেছেন তিনি। অধ্যাপক গোলাম আযম লিখিত কিছু বই ইংরেজী ছাড়াও উর্দু, তামিল ও অহমিয়া ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এ ছাড়া অধ্যাপক গোলাম আযমের জীবনী নিয়ে ইংরেজী ভাষায় একটিসহ ৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামী ঐক্যের প্রচেষ্টা:
১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন’ পুস্তিকায় সকল ইসলামী শক্তিকে এক প্লাটফর্মে সমবেত হওয়ার রূপরেখা প্রদান করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। ’৮১ সালের ডিসেম্বরে ঐ রূপরেখা অনুযায়ী ‘ইত্তেহাদুল উম্মাহ’ নামক ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যমঞ্চ গঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে ইসলামী ঐক্যের অগ্রগতি সম্পর্কে ‘ইসলামী ঐক্য প্রচেষ্টা’ শিরোনামে পুস্তিকা রচিত হয়। ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকাস্থ আল ফালাহ মিলনায়তনে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে ইসলামী ঐক্য গঠনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাটহাজারী ও পটিয়া মাদ্রাসার মুহতামিমদ্বয়ের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে মুহতামিমদ্বয় কর্তৃক চারদফা প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৯৬ সালে চারদফা প্রস্তাব গ্রহণ করে পত্রের উত্তর প্রদান। ১৯৯৭ সালে খুলনায় অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে ইসলামী ঐক্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে গওহারডাঙ্গা মাদ্রাসার মুহতামিম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়াত ও মহাসচিবের নিকট পত্র প্রেরণ করা হয়। ১৯৯৮ সালে ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ২০ বছর ধরে ইসলামী ঐক্য প্রচেষ্টার ধারাবাহিক বিবরণ দিয়ে ‘ইসলামী ঐক্যমঞ্চ চাই’ নামক পুস্তিকা রচনা।
৫ম বারের মতো কারাবরণ:
নির্ভীক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মজলুম জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই ৫ম বারের মতো কারাগারে গেলেন বর্ষীয়ান জননেতা, ভাষা সৈনিক জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম। এর আগে ভাষা আন্দোলনের সময় দুই বার(১৯৫২ ও ১৯৫৫ সালে)। ১৯৬৪ সালে(পাকিস্তান সরকার যখন জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে) একবার, ১৯৯২ সালে(বিএনপি তাকে বিদেশী নাগরিক হিসেবে গ্রেফতার করে) একবার আর সর্বশেষ গত ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আদেশে কারাবরণ করেন এই নেতা। প্রিজন সেলে থাকা অবস্থায়ই তিনি ইন্তিকাল করলেন।